Thursday, August 15, 2024

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না – নবারুন ভট্টাচার্য

 লক-আপের পাথর হিম কক্ষে

ময়না তদন্তের হ্যাজাক আলোক কাঁপিয়ে দিয়ে
হত্যাকারীর পরিচালিত বিচারালয়ে
মিথ্যা অশিক্ষার বিদ্যায়তনে
শোষণ ও ত্রাসের রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে
সামরিক-অসামরিক কর্তৃপক্ষের বুকে
কবিতার প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হোক
বাংলাদেশের কবিরাও
লোরকার মতো প্রস্তুত থাকুক
হত্যার শ্বাসরোধের লাশ নিখোঁজ হওয়ার স্টেনগানের গুলিতে সেলাই হয়ে
যাবার জন্য প্রস্তত থাকুক
তবু কবিতার গ্রামাঞ্চল দিয়ে
কবিতার শহরকে ঘিরে ফেলবার একান্ত দরকার।
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না
আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব
বুকের মধ্যে টেনে নেব কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল ও ভাসান
সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকি না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম
অগণিত হৃদয় শস্য, রূপকথা ফুল নারী নদী
প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেব ইচ্ছে মতো
ডেকে নেব টলমলে হাওয়া রৌদ্রের ছায়ায় মাছের চোখের মত দীঘি
ভালোবাসা-যার থেকে আলোকবর্ষ দুরে জন্মাবধি অচ্ছুৎ হয়ে আছি-
তাকেও ডেকে নেব কাছে বিপ্লবের উৎসবের দিন।

হাজার ওয়াট আলো চোখে ফেলে রাত্রিদিন ইনটারোগেশন
মানি না
নখের মধ্যে সূঁচ বরফের চাঙড়ে শুইয়ে রাখা
মানি না
পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা যতক্ষণ রক্ত ঝরে নাক দিয়ে
মানি না
ঠোঁটের ওপরে বুট জ্বলন্ত শলাকায় সারা গায় ক্ষত
মানি না
ধারালো চাবুক দিয়ে খন্ড খন্ড রক্তাক্ত পিঠে সহসা আ্যালকোহল
মানি না
নগ্নদেহে ইলেকট্রিক শক কুৎসিৎ বিক্রত যৌন অত্যাচার
মানি না
পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা খুলির সঙ্গে রিভলবার ঠেঁকিয়ে গুলি
মানি না
কবিতা কোন বাধাকে স্বীকার করে না
কবিতা সশস্ত্র কবিতা স্বাধীন কবিতা নির্ভীক।
চেয়ে দেখো মায়কোভস্কি হিকমেত নেরুদা আরাগঁ এলুয়ার
তোমাদের কবিতাকে আমরা হেরে যেতে দিইনি
বরং সারাটা দেশ জুড়ে নতুন একটা মহাকাব্য লেখবার চেষ্টা চলছে
গেরিলা ছন্দে রচিত হতে চলেছে সকল অলংকার।
গর্জে উঠুক দল মাদল
প্রবাল দ্বীপের মত আদিবাসী গ্রাম
রক্তে লাল নীলক্ষেত
শঙ্খচূড়ের বিষ-ফেনা মুখে আহত তিতাস
বিষাক্ত মৃত্যুসিক্ত তৃষ্ঞায় কুচিলা
টণ্কারের সূর্য অন্ধ উৎক্ষিপ্ত গান্ডীবের ছিলা

যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী
প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না
আমি তাকে ঘৃণা করি-
আটজন মৃতদেহ
চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে
আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি
আট জোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে
আমি চীৎকার করে উঠি
আমাকে তারা ডাকছে অবেলায় উদ্যানে সকল সময়
আমি উন্মাদ হয়ে যাব
আত্মহ্ত্যা করব
যা ইচ্ছা চায় তাই করব।

কবিতা এখনই লেখার সময়
ইস্তেহারে দেয়ালে স্টেনসিলে
নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে কোলাজ পদ্ধতিতে
এখনই কবিতা লেখা যায়
তীব্রতম যন্ত্রনায় ছিন্নভিন্ন মুখে
সন্ত্রাসের মুখোমুখি-ভ্যানের হেডলাইটের ঝলসানো আলোয়
স্থির দৃষ্টি রেখে
এখনই কবিতা ছুঁড়ে দেওয়া যায়
’৩৮ ও আরো যা যা আছে হত্যাকারীর কাছে

সব অস্বীকার করে এখনই কবিতা পড়া যায়

তীক্ষ্ম তীর হিংস্রতম ফলা-
ভাল্লা তোমার টাঙ্গি পাশ
ঝলকে ঝলকে বল্লম চর-দখলের সড়কি বর্শা
মাদলের তালে তালে রক্তচক্ষু ট্রাইবাল টোটেম
বন্দুক কুরকি দা ও রাশি রাশি সাহস
এত সাহস যে আর ভয় করে না
আরো আছে ক্রেন, দাঁতালো বুলডজার বনভয়ের মিছিল
চলামান ডাইনামো টারবাইন লেদ ও ইনজিন
ধ্বস-নামা কয়লার মিথেন অন্ধকারে কঠিন হীরার মতো চোখ
আশ্চর্য ইস্পাতের হাতুড়ি
ডক জুটমিল ফার্ণেসের আকাশে উত্তোলিত সহস্র হাত
না ভয় করে না
ভয়ের ফ্যাকাশে মুখ কেমন অচেনা লাগে
যখন জানি মৃত্যু ভালোবাসা ছাড়া কিছু নয়।
আমাকে হ্ত্যা করলে
বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে যাব
আমার বিনাশ নেই-
বছর বছর মাটির মধ্য হতে সবুজ আশ্বাস হয়ে ফিরে আসব
আমার বিনাশ নেই-
সুখে থাকব, দুঃখে থাকব সন্তান-জন্মে সৎকারে
বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন
মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন।

অস্বীকার করছি

 

অস্বীকার করছি

তুমি গুলিতে আমায় মেরে ফেলতেই পারো
কিন্তু গুলিতে আমরা মরেই যাবো, এটা জরুরি নয়।

হ্যাঁ স্বীকার করছি,
মৃত্যুকে আমরা ভয় পাই
কিন্তু ভয় পেয়ে আমরা ভীতসন্ত্রস্ত হব এটা জরুরি নয়।

আমি আদম ও হাওয়ার সন্তান
আমার মাতৃভূমি হিন্দুস্থান
মহম্মদ আমার নবী,আল্লাহ আমার খোদা
আম্বেদকর আমার শিক্ষক
বুদ্ধ আমার শুরু,নানক আমার গুরু
অন্ন আমার ধর্ম, প্রেম আমার ঈমান
আমি ভয় পেয়ে ভীত হওয়াতে
অপঘাতে মৃত্যুবরণ করতে অস্বীকার করছি।

আমি অত্যাচারকে অস্বীকার করছি
কারণ অন্যায় অত্যাচারকে অস্বীকার করা বিপ্লবের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রথম চরণ।
আমি পশ্চাদপসরণ করতে অস্বীকার করছি।

আমার প্রাণের ফয়সালা সাত ঘন্টার একটা সংসদ অধিবেশন থেকে হোক,
এটা আমার কাছে মঞ্জুর নয়।

আর আমার পরিচয়ের ফয়সালা কোনো পরিচয়পত্র থেকে হোক,
তা আমার কাছে মঞ্জুর নয়।
আমি এরকম সংসদ অধিবেশনকে, আমি এরকম পরিচয়পত্রকে অস্বীকার করছি।

আমারই দেশে আমাকে অধিকার দেওয়ার বদলে ভিক্ষা দেওয়া হবে
এটা আমার কাছে মঞ্জুর নয়।
আমাকে শুধুমাত্র একটা নামের মতো করে
কোনো রেজিষ্টারে লিখে দেওয়া হবে
এটা আমার কাছে মঞ্জুর নয়।
আমি অধিকারের বদলে ভিক্ষা দেওয়াকে
রেজিষ্টারে শুধুমাত্র কোনো নামের মতো করে লিখে দেওয়াকে অস্বীকার করছি।

আমি ক্ষতস্থানকে ফুল বলব?
অন্যায়কারীকে রসুল বলব?
কার্ফুকে লোকতন্ত্র বলব?
ঘৃণাকে নিয়ম বলব?

যে মিথ্যাকে সত্যি বলে
আমি এই প্রকার সমস্ত ভাষা কে অস্বীকার করছি।


সব মনে রাখা হবে

সব মনে রাখা হবে, সব কিছু মনে রাখা হবে,
তোমাদের লাঠি আর গুলিতে
খুন হয়েছে যে আমার বন্ধুরা
তাদের স্মৃতিতে আমাদের মনকে নষ্ট করেই রাখা হবে।
সব মনে রাখা হবে, সব কিছু মনে রাখা হবে।

তুমি কালিতে মিথ্যা লিখবে আমরা জানি
কিন্তু আমাদের রক্ত দিয়ে হলেও
সত্যিটা নিশ্চয়ই লেখা হবে।
সব মনে রাখা হবে, সব কিছু মনে রাখা হবে।

ভরদুপুরে মোবাইল টেলিফোন বন্ধ করে,
মধ্যরাতে গোটা শহরকে নজরবন্দী করে
সদলবলে হাতুরি নিয়ে আমার ঘরে ঢুকে পড়া
আমার মাথা, মুখ,আমার ছোট্ট জীবনকে ভেঙে দেওয়া
আমার কলিজার টুকরোকে চৌরাস্তায় অবলীলাক্রমে মেরে ফেলে
ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে থেকে তোমার মুচকি হাসি
সব মনে রাখা হবে, সব কিছু মনে রাখা হবে।

দিনের বেলায় সামনে এসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা
“সব কিছু ঠিক আছে, সব আচ্ছে হ্যায়!”
কথা বলতে গিয়ে তোতলানো
আর রাত্রি হলেই ন্যায্য দাবী চাওয়া লোকেদের উপর লাঠি,গুলি চালানো
আমাদের উপর আক্রমণ করে
আমাদেরকেই আক্রমণকারী বলা
সব মনে রাখা হবে, সবকিছু মনে রাখা হবে।

আমার হাড়ের উপর লিখে রাখবো এইসব কথা
তুমি যে চাইছো আমার অস্তিত্বের কাগজ
আমার অস্তিত্বের প্রমাণ তোমাকে অবশ্যই দেওয়া হবে।
এই যুদ্ধ তোমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়া হবে।
এটাও মনে রাখা হবে কিভাবে তুমি দেশকে বিভাজন করার ষড়যন্ত্র করেছো
এটাও মনে রাখা হবে
কত সাধ্যসাধনা করে আমরা দেশের ঐক্য রক্ষার চেষ্টা করে গেছি।
এটাও মনে রাখা হবে
যখনই জগতে কাপুরুষতার কথা উঠবে,
তোমার কুকর্ম মনে রাখা হবে
আর যখনই জগতে জীবনরক্ষার কথা উঠবে
আমাদের নাম মনে আসবে।
কিছু লোক ছিল যাদের সংকল্প লোহার হাতুড়িতে ভেঙে পড়েনি
কিছু লোক ছিল যাদের আত্মা বিক্রি হয়ে যায় নি
ইজারাদারদের পয়সার কাছে।
(যেমনটা তোমাদের বিক্রি হয়ে যায়।)
কিছু লোক ছিল যারা
তুফান চলে যাওয়া অবধি অটল ছিল
কিছু লোক ছিল যারা নিজের মৃত্যুসংবাদ আসা পর্যন্ত বেঁচে ছিল।
চোখের পাতা পলক ফেলা ভুলে যায় তো যাক
পৃথিবী নিজের কক্ষপথে ঘোরা ভুলে যায় তো যাক
তবু আমাদের কাটা পাখনার ঝটফটানি আর আমাদের ফাটা গলার আওয়াজ মনে রাখা হবে।

তুমি রাত লেখো আমরা চাঁদ লিখব
তুমি জেলে পোরো,আমরা দেওয়াল টপকানো লিখব
তুমি এফ আই আর লেখো
আমরা ‘প্রস্তুত আছি’ লিখব।
তুমি আমাদের খুন করে ফেলো
বরং তুমি আমাদের খুন করে ফেলো।
আমরা ভুত হয়ে তোমার খুনের সমস্ত প্রমাণ লিখব।

তুমি আদালতে বসে চুটকি লেখো
আমরা রাস্তায় দেওয়ালে সুবিচার লিখব।
বধির ও শুনতে পায় এমন জোরে বলব
অন্ধও দেখতে পায় এতোটাই স্পষ্ট লিখব।

তোমরা কালো পদ্ম লেখো
আর আমরা লাল গোলাপ লিখব।
তোমরা মাটিতে অত্যচার লেখো আকাশে বিপ্লব লেখা হবে।
সব মনে রাখা হবে, সব কিছু মনে রাখা হবে।

যাতে তোমার নামে চিরকাল অভিশাপ করা যায়
যাতে তোমাদের কুকর্মে কালিমা লেপা যায়।
তোমার নাম,তোমার কুকর্ম মনে রাখা হবে।


সহানুভূতি ও ভিড়তন্ত্র

সাহেব আপনার সহানুভূতি শুধুই সরকারি
ভিড়ের হাতে আমার মৃত্যু থাকবে জারি

কাল খুনের বাহানা একটা পশু ছিল
আজ খুনের বাহানা একটা রোগে পরিণত হয়েছে।

Sunday, August 4, 2024

ভাত দে হারামজাদা -কবি রফিক আজাদ

 ভীষন ক্ষুধার্ত আছিঃ উদরে, শারীরবৃত্ত ব্যেপে

অনুভূত হতে থাকে – প্রতিপলে – সর্বগ্রাসী ক্ষুধা
অনাবৃষ্টি যেমন চরিত্রের শস্যক্ষেত্রে জ্বেলে দেয়
প্রভূত দাহন – তেমনি ক্ষুধার জ্বালা, জ্বলে দেহ
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোনও দাবি
অনেক অনেক-কিছু চেয়ে নিয়েছে, সকলেই চায়ঃ
বাড়ি, গাড়ী, টাকাকড়ি- কারো বা খ্যাতির লোভ আছে;
আমার সামান্য দাবিঃ পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর-
ভাত চাই-এই চাওয়া সরাসরি – ঠান্ডা বা গরম,
সরূ বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চাল হ’লে
কোনো ক্ষতি নেই মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাইঃ
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে ছেড়ে দেবো অন্য সব দাবি!
অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি নেই যৌন ক্ষুধা-
চাইনি তো নাভিনিম্নে পড়া শাড়ি, শাড়ির মালিক;
যে চায় সে নিয়ে যাক – যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে দাও –
জেনে রাখোঃ আমার ও সব এ কোনও প্রয়োজন নেই।

যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবি,
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কান্ড ঘটে যাবে;
ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন-কানুন –
সমুখে যা পাবো খেয়ে নেবো অবলীলাক্রমে;
যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে, ধর, পেয়ে যাই –
রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে।
সর্বপরিবেশগ্রাসী হ’লে সামান্য ভাতের ক্ষুধা
ভয়াবহ পরিনতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ করে!

দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অবধি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবোঃ গাছপালা, নদী-নালা,
গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাথ, নর্দমার জলের প্রপাত,
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব-প্রধান নারী,
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী-
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ।
ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো।