Saturday, May 2, 2015

গতকাল একদিন - নির্মেলন্দু গুণ

গতকাল বড়ো ছেলেবেলা ছিল 
আমাদের চারিধারে, 
দেয়ালের মতো অনুভূতিমাখা মোম 
জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে আমারা দেখেছি 
শিখার ভিতরে মুখ । 
গতকাল ছিল জীবনের কিছু 
মরণের মতো সুখ । 

গতকাল বড়ো যৌবন ছিল 
শরীরে শরীর ঢালা, 
ফুলের বাগান ঢেকে রেখেছিল 
উদাসীন গাছপালা । 

আমরা দু’জনে মাটি খুঁড়ে-খুঁড়ে 
লুকিয়েছিলাম প্রেম, 
গতকাল বড় ছেলেবেলা ছিল 
বুঝিনি কী হারালাম ! 

গতকাল বড়ো এলোমেলো চুলে 
বাতাস তুলেছে গ্রিবা, 
চুমু খেয়ে গেছে কৃষ্ণচূড়ার 
উজ্জ্বল মধুরিমা । 

গতকাল বড়ো মুখোমুখি ছিল 
সারাজীবনের চাওয়া, 
চোখের নিমিষে চোখের ভিতরে 
চোখের বাহিরে যাওয়া । 

আকাশ ও মানুষ - নির্মেলন্দু গুণ

কবে থেকে আকাশ দাঁড়িয়ে আছে একা, 
তার বুক থেকে খসে পড়েছে কত তারা। 
বেঁচে থাকলে আরো কত তারাই খসবে, 
তা নিয়ে আকাশ কি দুঃখ করতে বসবে? 

না, বসবে না, আমি বলছি, লিখে নাও, 
আকাশকে তো মহান মানি এ-কারণেই। 
মনুষ্যবৎ হলে কি মানুষ তাকে মানতো? 

প্রিয়জন চলে গেলে মানুষই ব্যথিত হয়, 
আকাশ নির্বিকার, আকাশ কখনও নয়। 
তোমরা মানুষ, তাই সহজেই দুঃখ পাও, 
হে ঈশ্বর, আমাকে আকাশ করে দাও। 

আগ্নেয়াস্ত্র -নির্মেলন্দু গুণ

পুলিশ স্টেশনে ভিড়,আগ্নেয়াস্ত্র জমা নিচ্ছে শহরের 
সন্দিগ্ধ সৈনিক।সামরিক নির্দেশে ভীত মানুষের 
শটগান,রাইফেল,পিস্তল এবং কার্তুজ,যেন দরগার 
স্বীকৃত মানত,টেবিলে ফুলের মতো মস্তানের হাত। 

আমি শুধু সামরিক আদেশ অমান্য করে হয়ে গেছি 
কোমল বিদ্রোহী,প্রকাশ্যে ফিরছি ঘরে 
অথচ আমার সঙ্গে হৃদয়ের মতো মারাত্তক 
একটি আগ্নেয়াস্ত্র,আমি জমা দেইনি। 

এবারই প্রথম তুমি - নির্মেলন্দু গুণ



ভুলে যাও তুমি পূর্বেও ছিলে 
মনে করো এই বিশ্ব নিখিলে 
এবারই প্রথম তুমি। 

এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না 
ছিলে না আকাশে, নদী জলে ঘাসে 
ছিলে না পাথরে ঝর্ণার পাশে। 
এবারই প্রথম তুমি। 

এর আগে তুমি কিছুতে ছিলে না। 
ফুলেও ছিলে না, ফলেও ছিলে না 
নাকে মুখে চোখে চুলেও ছিলে না। 
এবারই প্রথম তুমি। 

এর আগে তুমি এখানে ছিলে না 
এর আগে তুমি সেখানে ছিলে না 
এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না। 
এবারই প্রথম তুমি। 

রাতের পুণ্য লগনে ছিলে না 
নীল নবঘন গগনে ছিলে না। 
এবারই প্রথম তুমি। 

এর আগে তুমি তুমিও ছিলে না। 
এবারই প্রথম তুমি। 

টেলিফোনে প্রস্তাব - নির্মেলন্দু গুণ

আমি জানি, আমাদের কথার ভিতরে এমন কিছুই নেই, 
অনর্থ করলেও যার সাহায্যে পরস্পরের প্রতি আমাদের 
দুর্বলতা প্রমাণ করা সম্ভব। আমিও তো তোমার মতোই 
অসম্পর্কিত-জ্ঞানে এতদিন উপস্থাপন করেছি আমাকে। 
তুমি যখন টেলিফোন হয়ে প্রবেশ করেছো আমার কর্ণে- 
আমার অপেক্ষাকাতর হৃৎপিণ্ডের সামান্য কম্পনও আমি 
তোমাকে বুঝতে দিই নি। দুর্বলতা ধরা পড়ে যায় পাছে। 

তুমিও নিষ্ঠুর কম নও, তুমি বুঝতে দাওনা কিছু। জানি, 
আমার কাছেই তুমি শিখেছিলে এই লুকোচুরি করা খেলা। 
কিন্তু এখন, যখন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে আমাদের বেলা, 
তখন ভেতরের চঞ্চলতাকে আমরা আর কতটা লুকাবো? 
অস্ত যাবার আগে প্রবল সূর্যও চুম্বন করে পর্বত শিখর, 
আর আমরা তো দুর্বল মানুষ, মিলনে বিশ্বাসী নর-নারী। 
কার ভয়ে, কী প্রয়োজনে আমরা তাহলে শামুকের মতো 
স্পর্শমাত্র ভিতরে লুকাই আমাদের পল্লবিত বাসনার শূঁড়। 

তার চেয়ে চল এক কাজ করি, তুমি কান পেতে শোনো, 
তুমি শুধু শোনো, আর আমি শুধু বলি, বলি, ভালবাসি। 

পূর্ণিমার মধ্যে মৃত্যু -নির্মেলন্দু গুণ

একদি চাঁদ উঠবে না, সকাল দুপুরগুলো 
মৃতচিহ্নে স্থির হয়ে রবে; 
একদিন অন্ধকার সারা বেলা প্রিয় বন্ধু হবে, 
একদিন সারাদিন সূর্য উঠবে না। 

একদি চুল কাটতে যাব না সেলুনে 
একদিন নিদ্রাহীন চোখে পড়বে ধুলো। 
একদিন কালো চুলগুলো খ’সে যাবে, 
কিছুতেই গন্ধরাজ ফুল ফুটবে না। 

একদিন জনসংখ্যা কম হবে এ শহরে, 
ট্রেনের টিকিট কেটে 
একটি মানুষ কাশবনে গ্রামে ফিরবে না। 
একদিন পরাজিত হবো। 

একদিন কোথাও যাব না, শূন্যস্থানে তুমি 
কিম্বা অন্য কেউ বসে থেকে বাড়াবে বয়স। 
একদিন তোমাকে শাসন করা অসম্ভব ভেবে 
পূর্ণিমার রাত্রে মরে যাব। 

শুধু তোমার জন্য - নির্মেলন্দু গুণ

কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে 
গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন। 
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও 
কতবার যে আমি সে কথা বলিনি 
সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন। 
তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য 
দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম 
আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ 
‘এই ওঠো, 
আমি, আ…মি…।‘ 
আর অমি এ-কী শুনলাম 
এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে 
কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে 
কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন। 
আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য, 
আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য, 
আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য। 
তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে, 
আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য। 

মানুষ - নির্মেলেন্দু গুণ

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম, 
হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়, 
মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় । 

আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি, 
গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি। 
সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না, 
অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না । 
কী করে তfও বেঁচে থাকছি, ছবি আঁকছি, 
সকালবেলা, দুপুরবেলা অবাক করে 
সারাটা দিন বেঁচেই আছি আমার মতে । অবাক লাগে । 

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো, 
বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো, 
রাত্রিবেলায় ঘরের মধ্যে নারী থাকতো, 
পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো । 

আমি হয়তো মানুষ নই, 
মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন ? 
মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে, 
নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে, 
নিকেলমাখা কী সুন্দর চোখ থাকবে 
ভালোবাসার কথা দিলেই কথা রাখবে । 

মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো , 
বাবা থাকতো, বোন থাকতো, 
ভালোবাসার লোক থাকতো, 
হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো । 

আমি হয়তো মানুষ নই, 
মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা 
আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত 
বেঁচে থাকাটা আর হতো না । 

মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ; 
অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই, 
অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি ।