Thursday, February 19, 2015

বাঁচবে না কবির হৃদয় - মহাদেব সাহা (কোথা সেই প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ)

তোমার দেখা না পেলে একটিও কবিতা হবে না
দুই চোখ কোথাও পাবে না খুঁজে একটি উপমা,
কবিতার পান্ডুলিপি হবে দগ্ধ রুক্ষ মরুময়
তোমার দেখা না পেলে কাটবে না এই দু:সময়।
তোমার দেখা না পেলে সবখানে গোলযোগ হবে
দুর্ঘটনা,যানজট,বিশৃঙ্খলা বাড়বে কেবল,
সর্বত্র বাড়বে রোগ,অনাবৃষ্টি আর দীর্ঘ খরা
প্রত্যহ বাধবে শুধু কলহ-কোন্দল আর যুদ্ধ-হানাহানি
তোমার দেখা না পেলে হবে শুষ্ক এই জলাশয়,
তোমার দেখা না পেলে বাঁচবে না কবির হৃদয়।

সুন্দরের হাতে আজ হাতকড়া, গোলাপের বিরুদ্ধে হুলিয়া – মহাদেব সাহা

সুন্দরের হাতে আজ হাতকড়া, গোলাপের বিরুদ্ধে
হুলিয়া,
হৃদয়ের তর্জমা নিষিদ্ধ আর মননের সম্মুখে প্রাচীর
বিবেক নিয়ত বন্দী, প্রেমের বিরুদ্ধে পরোয়ানা;
এখানে এখন পাখি আর প্রজাপতি ধরে ধরে
কারাগারে রাখে-
সবাই লাঞ্ছিত করে স্বর্ণচাঁপাকে;
সুপেয় নদীর জলে ঢেকে দেয় বিষ, আকাশকে
করে উপহাস।
আলোর বিরুদ্ধাচারী আঁধারের করে শুধু স্ততি,
বসন্তের বার্তা শুনে জারি করে পূর্বাহ্নে কারফিউ,
মানবিক উৎসমুখে ফেলে যতো শিলা ও পাথর-
কবিতাকে বন্দী করে, সৌন্দর্যকে পরায় শৃঙ্খল।

বড় একা আমি - মহাদেব সাহা

বড় একা আমি
নিজের ছায়ার মতো
শূন্যতার মতো
দীর্ঘশ্বাসের মতো
নিঃসঙ্গ বৃক্ষের মতো
নির্জন নদীর মতো
বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো
মৌন পাহাড়ের মতো
আজীবন সাজা প্রাপ্ত দন্ডপ্রাপ্ত আসামির মতো
বড় একা আমি, বড় একা ...

Friday, February 13, 2015

ক্যাকটাস - হেলাল হাফিজ (যে জলে আগুন জ্বলে)

দারুন আলাদা একা অভিমানী এই ক্যাকটাস।
যেন কোন বোবা রমণীর সখী ছিলো দীর্ঘকাল
কিংবা আজন্ম শুধু দেখেছে আকাল
এরকম ভাব-ভঙ্গি তার।
ধ্রুপদী আঙিনা ব্যাপী
কন্টকিত হাহাকার আর অবহেলা,
যেন সে উদ্ভিদ নয়
তাকালেই মনে হয় বিরান কারবালা।

হয় তো কেটেছে তার মায়া ও মমতাহীন সজল শৈশব
অথবা গিয়েছে দিন
এলোমেলো পরিচর্যাহীন এক রঙিন কৈশোর,
নাকি সে আমার মত খুব ভালোবেসে
পুড়েছে কপাল তার আকালের এই বাংলাদেশে।

বোকা উদ্ভিদ তবে কি
মানুষের কাছে প্রেম চেয়েছিলো?
চেয়েছিলো আরো কিছু বেশি।

৩০.৬.৮২

তুমি চলে যাবে বলতেই - মহাদেব সাহা (যদুবংশ ধ্বংসের আগে)

তুমি চলে যাবে বলতেই বুকের মধ্যে
পাড় ভাঙার শব্দ শুনি-
উঠে দাঁড়াতেই দুপুরের খুব গরম হাওয়া বয়,
মার্সির কাঁচ ভাঙতে শুরু করে;
দরোজা থেকে যখন এক পা বাড়াও আমি
দুই চোখে কিছুই দেখি না-
এর নাম তোমার বিদায়, আচ্ছা আসি, শুভরাত্রি,
খোদা হাফেজ।
তোমাকে আরেকটু বসতে বললেই তুমি যখন
মাথা নেড়ে না, না বলো
সঙ্গে সঙ্গে সব মাধবীলতার ঝোপ ভেঙে পড়ে;
তুমি চলে যাওয়ার জন্যে যখন সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকো
তৎক্ষণাৎ পৃথিবীর আরো কিছু বনাঞ্চল উজাড়
হয়ে যায়,
তুমি উঠোন পেরুলে আমি কেবল শূন্যতা শূন্যতা
ছাড়া আর কিছুই দেখি না
আমার প্রিয় গ্রন্থগুলির সব পৃষ্ঠা কালো কালিতে ঢেকে যায়।
অথচ চোখের আড়াল অর্থ কতোটুকু যাওয়া,
কতোদূর যাওয়া- হয়তো নীলক্ষেত থেক বনানী, ঢাকা থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট
তবু তুমি চলে যাবে বলতেই বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে
সেই থেকে অবিরাম কেবল পাড় ভাঙার শব্দ শুনি
পাতা ঝরার শব্দ শুনি-
আর কিছুই শুনি না।

হৃদয়ের ঋণ - হেলাল হাফিজ (যে জলে আগুন জ্বলে)

আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে
কলঙ্ক হবে কলঙ্ক হবে তোর,
খুব সামান্য হৃদয়ের ঋণ পেলে
বেদনাকে নিয়ে সচ্ছলতার ঘর

বাঁধবো নিমেষে। শর্তবিহীন হাত
গচ্ছিত রেখে লাজুক দু’হাতে আমি
কাটাবো উজাড় যুগলবন্দী হাত
অযুত স্বপ্নে। শুনেছি জীবন দামী,

একবার আসে, তাকে ভালোবেসে যদি
অমার্জনীয় অপরাধ হয় হোক,
ইতিহাস দেবে অমরতা নিরবধি
আয় মেয়ে গড়ি চারু আনন্দলোক।

দেখবো দেখাবো পরস্পরকে খুলে
যতো সুখ আর দুঃখের সব দাগ,
আয় না পাষাণী একবার পথ ভুলে
পরীক্ষা হোক কার কতো অনুরাগ।

২২.৬.৮৩

গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না - হুমায়ূন আহমেদ

প্রতি পূর্নিমার মধ্যরাতে একবার আকাশের দিকে তাকাই
গৃহত্যাগী হবার মত জ্যোৎস্না কি উঠেছে ?
বালিকা ভুলানো জ্যোৎস্না নয়।
যে জ্যোৎস্নায় বালিকারা ছাদের রেলিং ধরে ছুটাছুটি করতে করতে বলবে-
ও মাগো, কি সুন্দর চাঁদ !
নবদম্পতির জ্যোৎস্নাও নয়।
যে জ্যোৎস্না দেখে স্বামী গাঢ় স্বরে স্ত্রীকে বলবেন-
দেখ দেখ নীতু চাঁদটা তোমার মুখের মতই সুন্দর !
কাজলা দিদির স্যাঁতস্যাতে জ্যোৎস্না নয়।
যে জ্যোৎস্না বাসি স্মৃতিপূর্ন ডাস্টবিন উল্টে দেয় আকাশে।
কবির জ্যোৎস্না নয়। যে জ্যোৎস্না দেখে কবি বলবেন-
কি আশ্চর্য রূপার থালার মত চাঁদ !
আমি সিদ্ধার্থের মত গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নার জন্য বসে আছি।
যে জ্যোৎস্না দেখামাত্র গৃহের সমস্ত দরজা খুলে যাবে-
ঘরের ভেতরে ঢুকে পরবে বিস্তৃত প্রান্তর।
প্রান্তরে হাঁটব, হাঁটব আর হাঁটব-
পূর্নিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে মধ্য আকাশে।
চারদিক থেকে বিবিধ কন্ঠ ডাকবে- আয় আয় আয়।

ইশতেহার - রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

পৃথিবীতে মানুষ তখনও ব্যক্তিস্বার্থে ভাগ হয়ে যায়নি ।
ভুমির কোনো মালিকানা হয়নি তখনো ।
তখনো মানুষ শুধু পৃথিবীর সন্তান ।

অরন্য আর মরুভূমির
সমুদ্র আর পাহাড়ের ভাষা তখন আমরা জানি ।
আমরা ভূমিকে কর্ষন করে শস্য জন্মাতে শিখেছি ।
আমরা বিশল্যকরনীর চিকিৎসা জানি
আমরা শীত আর উত্তাপে সহনশীল
ত্বক তৈরি করেছি আমাদের শরীরের ।
আমরা তখন সোমরস, নৃত্য আর
শরীরের পবিত্র উৎসব শিখেছি ।

আমাদের নারীরা জমিনে শস্য ফলায়
আর আমাদের পুরুষেরা শিকার করে ঘাই হরিন।
আমরা সবাই মিলে খাই আর পান করি ।
জ্বলন্ত আগুনকে ঘিরে সবাই আমরা নাচি
আর প্রশংসা করি পৃথিবীর ।
আমরা আমাদের বিস্ময় আর সুন্দরগুলোকে বন্দনা করি ।

পৃথিবীর পূর্নিমা রাতের ঝলোমলো জ্যোৎস্নায়
পৃথিবীর নারী আর পুরুষেরা
পাহাড়ের সবুজ অরন্যে এসে শরীরের উৎসব করে ।

তখন কী আনন্দরঞ্জিত আমাদের বিশ্বাস ।
তখন কী শ্রমমুখর আমাদের দিনমান ।
তখন কী গৌরবময় আমাদের মৃত্যু ।
তারপর –
কৌমজীবন ভেঙে আমরা গড়লাম সামন্ত সমাজ ।
বন্যপ্রানীর বিরুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য অস্ত্রগুলো
আমরা ব্যবহার করলাম আমাদের নিজের বিরুদ্ধে ।
আমাদের কেউ কেউ শ্রমহীনতায় প্রশান্তি খুঁজে পেতে চাইলো ।
দুর্বল মানুষেরা হয়ে উঠলো আমাদের সেবার সামগ্রী ।
আমাদের কারো কারো তর্জনী জীবন ও মৃত্যুর নির্ধারন হলো ।

ভারী জিনিস টানার জন্যে আমরা যে চাকা তৈরি করেছিলাম
তাকে ব্যবহার করলাম আমাদের পায়ের পেশীর আরামের জন্যে ।
আমাদের বন্য অস্ত্র সভ্যতার নামে
গ্রাস করে চললো মানুষের জীবন ও জনপদ ।

আমরা আমাদের চোখকে সুদূরপ্রসারী করার জন্যে দূরবীন
আর সূক্ষ্ নিরীক্ষনের জন্যে অনুবীক্ষন তৈরি করলাম ।
আমাদের পায়ের গতি বর্ধন করলো উড়ন্ত বিমান ।

আমাদের কন্ঠস্বর বর্ধিত হলো,
আমাদের ভাষা ও বক্তব্য গ্রন্থিত হলো,
আমরা রচনা করলাম আমাদের অগ্রযাত্রার ইতিহাস ।
আমাদের মস্তিষ্ককে আরো নিখুঁত ও ব্যপক করার জন্যে
আমরা তৈরি করলাম কম্পিউটার ।

আমাদের নির্মিত যন্ত্র শৃঙ্খলিত করলো আমাদের
আমাদের নির্মিত নগর আবদ্ধ করলো আমাদের
আমাদের পুঁজি ও ক্ষমতা অবরুদ্ধ করলো আমাদের
আমাদের নভোযান উৎকেন্দ্রিক করলো আমাদের ।

অস্তিত্ব রক্ষার নামে আমরা তৈরী করলাম মারনাস্ত্র ।
জীবনরক্ষার নামে আমরা তৈরি করলাম
জীবনবিনাশী হাতিয়ার ।
আমরা তৈরি করলাম পৃথিবী নির্মূল-সক্ষম পারমানবিক বোমা ।

একটার পর একটা খাঁচা নির্মান করেছি আমরা ।
আবার সে খাঁচা ভেঙে নতুন খাঁচা বানিয়েছি –
খাঁচার পর খাঁচায় আটকে পড়তে পড়তে
খাঁচার আঘাতে ভাঙতে ভাঙতে, টুকরো টুকরো হয়ে
আজ আমরা একা হয়ে গেছি ।

প্রত্যেকে একা হয়ে গেছি ।
কী ভয়ংকর এই একাকীত্ব !
কী নির্মম এই বান্ধবহীনতা !
কী বেদনাময় এই বিশ্বাসহীনতা !

এই সৌরমন্ডলের
এই পৃথিবীর এক কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে
যে-শিশুর জন্ম ।
দিগন্তবিস্তৃত মাঠে ছুটে বেড়ানোর অদম্য স্বপ্ন
যে-কিশোরের ।
জ্যোৎস্না যাকে প্লাবিত করে ।
বনভূমি যাকে দুর্বিনীত করে ।
নদীর জোয়াড় যাকে ডাকে নশার ডাকের মতো ।
অথচ যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ঔপনিবেশিক জোয়াল
গোলাম বানানোর শিক্ষাযন্ত্র ।
অথচ যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে
এক হৃদয়হীন ধর্মের আচার ।
অথচ যাকে শৃঙ্খলিত করা হয়েছে স্বপ্নহীন সংস্কারে ।

যে-তরুন উনসত্তরের অন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে
যে-তরুন অস্ত্র হাতে স্বাধীনতাযুদ্ধে গিয়েছে
যে-তরুনের বিশ্বাস, স্বপ্ন, সাধ,
স্বাধীনতা-উত্তরকালে ভেঙে খান খান হয়েছে,
অন্তবে রক্তাক্ত যে-তরুন নিরুপায় দেখেছে নৈরাজ্য,
প্রতারনা আর নির্মমতাকে ।
দুর্ভিক্ষ আর দুঃশাসন যার নির্ভৃত বাসনাগুলো
দুমড়ে মুচড়ে তছনছ করেছে
যে-যুবক দেখেছে এক অদৃশ্য হাতের খেলা
দেখেছে অদৃশ্য এক কালোহাত
যে-যুবক মিছিলে নেমেছে
বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছে
আকন্ঠ মদের নেশায় চুর হয়ে থেকেছে
অনাহারে উড়নচন্ডী ঘুরছে
যে-যুবক ভয়ানক অনিশ্চয়তা আর বাজির মুখে
ছুঁড়ে দিয়েছে নিজেকে
যে-পুরুষ এক শ্যমল নারীর সাথে জীবন বিনিময় করেছে
যে-পুরুষ ক্ষুধা, মৃত্যু আর বেদনার সাথে লড়ছে এখনো,
লড়ছে বৈষম্য আর শ্রেনীর বিরুদ্ধে –
সে আমি ।

আমি একা ।
এই ব্রক্ষ্মান্ডের ভিতর একটি বিন্দুর মতো আমি একা ।
আমার অন্তর রক্তাক্ত ।
আমার মস্তিষ্ক জর্জরিত ।
আমার স্বপ্ন নিয়ন্ত্রিত ।
আমার শবীর লাবন্যহীন ।
আমার জীভ কাটা ।
তবু এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন আমাকে কাতর করে
আমাকে তড়ায়...

আমাদের কৃষকেরা
শূন্য পাকস্থলি আর বুকের ক্ষয়কাশ নিয়ে মাঠে যায় ।
আমাদের নারীরা ক্ষুধায় পীড়িত, হাড্ডিসার ।
আমাদের শ্রমিকেরা স্বাস্থহীন ।
আমাদের শিশুরা অপুষ্ট, বীভৎস-করুন ।
আমাদের অধিকাংশ মানুষ ক্ষুধা, অকালমৃত্যু আর
দীর্ঘশ্বাসের সমুদ্রে ডুবে আছে ।

পৃথিবীর যুদ্ধবাজ লোকদের জটিল পরিচালনায়
ষড়যন্ত্রে আর নির্মমতায়,
আমরা এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা
আর চরম অসহায়ত্বের আবর্তে আটকে পড়েছি ।
কী বেদনাময় এই অনিশ্চয়তা !
আর চরম অসহায়ত্বের আবর্তে আটকা পড়েছি ।
কী বেদনাময় এই অনিশ্চয়তা !
কী বিভৎস এই ভালোবাসাহীনতা !
কী নির্মম এই স্বপ্নহীনতা !

আজ আমরা আবার সেই
বিশ্বাস আর আনন্দকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
সাহস আর সরলতাকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
শ্রম আর উৎসবকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
ভালোবাসা আর প্রশান্তিকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
স্বাস্থ্য আর শরীরের লাবন্যকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
কান্নাহীন আর দীর্ঘশ্বাসহীন জীবনের কাছে যেতে চাই
আর আমরা শোষন আর ষঠতা
অকালমৃত্যু আর ক্ষুধার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতে চাই ।

আমাদের সমৃদ্ধ এই বিজ্ঞান নিয়ে
আমাদের অভিজ্ঞতাময় এই শিল্পসম্ভার নিয়ে
আমাদের দূরলক্ষ্য আর সুক্ষ্ম বীক্ষন নিয়ে
আমাদের দ্বন্ধময় বেগবান দর্শন নিয়ে
আমরা ফিরে যাবো আমাদের বিশ্বাসের পৃথিবীতে
আমাদের শ্রম, উৎসব, আনন্দ আর প্রশান্তির পৃথিবীতে ।
পরমানুর সঠিক ব্যবহার
আমাদের শস্যের উৎপাদন প্রয়োজনতুল্য করে তুলবে,
আমাদের কারখানাগুলো কখনোই হত্যার অস্ত্র তৈরি করবে না,
আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান নিরোগ করবে পৃথিবীকে;
আমাদের মর্যদার ভিত্তি হবে মেধা, সাহস আর শ্রম ।
আমাদের পুরুষেরা সুলতানের ছবির পুরুষের মতো
স্বাস্থ্যবান, কর্মঠ আর প্রচন্ড পৌরষদীপ্ত হবে ।
আমাদের নারীরা হবে শ্রমবতী, লক্ষীমন্ত আর লাবন্যময়ী ।
আমাদের শিশুরা হবে পৃথিবীর সুন্দরতম সম্পদন।

আমরা শস্য আর স্বাস্থের, সুন্দর আর গৌরবের
কবিতা লিখবো ।
আমরা গান গাইবো
আমাদের বসন্ত আর বৃষ্টির বন্দনা করে ।
আমরা উৎসব করবো শস্যের
আমরা উৎসব করবো পূর্নিমার
আমরা উৎসবা করবো
আমাদের গৌরবময় মৃত্যু আর বেগমান জীবনের ।

কিন্তু –
এই স্বপ্নের জীবনে যাবার পথ আটকে আছে
সামান্য কিছু মানুষ ।
অস্ত্র আর সেনা-ছাউনিগুলো তাদের দখলে ।
সমাজ পরিচালনার নামে তারা এক ভয়ংকর কারাগার
তৈরী করেছে আমাদের চারপাশে ।

তারা ক্ষুধা দিয়ে আমাদের বন্দী করেছে
তারা বস্ত্রহীনতা দিয়ে আমাদের বন্দী করেছে
তারা গৃহহীনতা দিয়ে আমাদের বন্দী করেছে
তারা জুলুম দিয়ে আমাদের বন্দী করেছে
বুলেট দিয়ে বন্দী করেছে ।

তারা সবচেয়ে কম শ্রম দেয়
আর সবচে বেশি সম্পদ ভোগ করে;
তারা সবচে ভালো খাদ্যগুলো খায়
আর সবচে দামি পোশাকগুলো পরে ।
তাদের পুরুষদের শরীর মেদে আবৃত, কদাকার;
তাদের মেয়েদের মুখের ত্বক দেখা যায় না, প্রসাধনে ঢাকা;
তারা আলস্য আর কর্মহীনতায় কাতর, কুৎসিত ।

তারা আমাদের জীভ কেটে নিতে চায়
তারা আমাদের চোখ উপড়ে ফেলতে চায়
তারা আমাদের মেধা বিকৃত করতে চায়
তারা আমাদের শ্রবন বধির করে দিতে চায়
তারা আমাদের পেশীগুলো অকেজো করে দিতে চায়
আমাদের সন্তানদেরও তারা চায় গোলাম বানাতে ;

একদা অরন্যে
যেভাবে অতিকায় বন্যপ্রানী হত্যা করে
আমরা অরন্যজীবনে শান্তি ফিরিয়ে এনেছি,
আজ এইসব অতিকায় কদাকার বন্যমানুষগুলো
নির্মুল করে
আমরা আবার সমতার পৃথিবী বানাবো
সম্পদ আর আনন্দের পৃথিবী বানাবো
শ্রম আর প্রশান্তির পৃথিবী বানাবো ।

এ কেমন ভ্রান্তি আমার - রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

এ কেমন ভ্রান্তি আমার !
এলে মনে হয় দূরে স’রে আছো, বহুদূরে,
দূরত্বের পরিধি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে আকাশ।
এলে মনে হয় অন্যরকম জল হাওয়া, প্রকৃতি,
অন্য ভূগোল, বিষুবরেখারা সব অন্য অর্থবহ-
তুমি এলে মনে হয় আকাশে জলের ঘ্রান।

হাত রাখলেই মনে হয় স্পর্শহীন করতল রেখেছো চুলে,
স্নেহ- পলাতক দারুন রুক্ষ আঙুল।
তাকালেই মনে হয় বিপরীত চোখে চেয়ে আছো,
সমর্পন ফিরে যাচ্ছে নগ্ন পায়ে একাকী বিষাদ- ক্লান্ত
করুণ ছায়ার মতো ছায়া থেকে প্রতিচ্ছায়ে।
এলে মনে হয় তুমি কোনদিন আসতে পারোনি..

কুশল শুধালে মনে হয় তুমি আসোনি
পাশে বসলেও মনে হয় তুমি আসোনি।
করাঘাত শুনে মনে হয় তুমি এসেছো,
দুয়ার খুল্লেই মনে হয় তুমি আসোনি।
আসবে বললে মনে হয় অগ্রিম বিপদবার্তা,
আবহাওয়া সংকেত, আট, নয়, নিম্নচাপ, উত্তর, পশ্চিম-
এলে মনে হয় তুমি কোনদিন আসতে পারোনি।

চ’লে গেলে মনে হয় তুমি এসেছিলে,
চ’লে গেলে মনে হয় তুমি সমস্ত ভূবনে আছো।